ঢাকা ১১:০৬ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪, ২৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি ::
আমাদের নিউজপোর্টালে আপনাকে স্বাগতম... সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে...

বরিশালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কোন্দল আরও বেড়েছে

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:৫৯:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ৯৬ বার পড়া হয়েছে

বরিশালে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের তীব্রতা বেড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপিতে। ক্ষমতাসীন দলে পরিবারকেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পুরোনো বিরোধ এখন বেড়েছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি যখন আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছে, তখন দলটিতে কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বিদায়ী মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ প্রার্থী হতে পারেন—এমন গুঞ্জন থেকে আওয়ামী লীগের কোন্দল মাথাচাড়া দিয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তাঁর সঙ্গে সাদিক আবদুল্লাহর বিরোধ অনেক পুরোনো। বিএনপিতে উপজেলা থেকে শুরু করে মহানগর পর্যন্ত কমিটি নিয়ে কোন্দলের জেরে নিজেদের মধ্যে মারামারি, বিক্ষোভ, দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝোলানোর মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
জাহিদ ফারুক বরিশাল-৫ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। অন্যদিকে সাদিক আবদুল্লাহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মেয়র পদে মনোনয়ন না পাওয়ায় সাদিক আবদুল্লাহর রাজনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। অবস্থান ধরে রাখতে সংসদ নির্বাচনে সদর আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাচ্ছেন তিনি। দলের সহযোগী সংগঠনে সমর্থকদের নেতৃত্বে আনা, দল গোছানো থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা সেই তৎপরতার অংশ বলে মনে হচ্ছে।

দলীয় সূত্র জানায়, জাহিদ ফারুকের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয় গত ঈদুল আজহার পর। ঈদের দিন রাতে হঠাৎ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন করেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম। সাদিক আবদুল্লাহসহ মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সেখানে যোগ দিলেও আমন্ত্রণ পাননি জাহিদ ফারুক ও নবনির্বাচিত মেয়র খায়ের আবদুল্লাহ। মাহবুব উদ্দিনকে মাঠে নামানোর পেছনে সাদিক আবদুল্লাহর সায় ছিল, নগরে এমন গুঞ্জন আছে। অবশ্য মাসখানেক আগে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন সাদিক আবদুল্লাহ।

দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকে বরিশালে অনুপস্থিত ছিলেন সাদিক আবদুল্লাহ। প্রায় আড়াই মাস পর ২২ জুন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশকে নিয়ে বরিশালে ফেরেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নগরে বিশাল শোভাযাত্রা হয়। সেই আয়োজনে নবনির্বাচিত মেয়র খায়ের আবদুল্লাহ ও তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি। এরপর ঈদুল আজহার নামাজ শেষে চাচা খায়ের আবদুল্লাহর সঙ্গে কোলাকুলি করলেও সেখানে উপস্থিত প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেননি সাদিক।

জাতীয় শোক দিবস ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানে খায়ের আবদুল্লাহ সদর আসনে আবার জাহিদ ফারুককে মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানান। ওই সভায় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী প্রধান অতিথি ছিলেন। তাঁরা দুজন ঐক্যবদ্ধভাবে বরিশালের উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর বরিশালের রাজনীতিতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়। এ সময় শওকতের সমর্থকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য হলে ওই নেতা-কর্মীদের অনেকে জাহিদ ফারুকের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে দলে আলাদা বলয় তৈরি হয়। সিটি নির্বাচনে যে বলয়টি খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে কাজ করে। এতে আওয়ামী লীগে বিভেদ প্রকাশ্যে আসে।
ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম বলেন, ‘বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। তিনি সজ্জন ব্যক্তি। দলের সভাপতি অবশ্যই জনকল্যাণ হয়, এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবেন। গত সিটি নির্বাচনে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।’

সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘এখানে যিনি নৌকা পাবেন, তাঁর পক্ষে দল ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।’ দলীয় বিভেদ প্রভাব ফেলবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিটি নির্বাচনেই তো প্রভাব পড়েনি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার জয় নিশ্চিত করতে কাজ করেছি। ভবিষ্যতেও প্রভাব পড়বে না।’
বরিশালে বিএনপির সাংগঠনিক বিপর্যয় শুরু মূলত ২০২১ সালের নভেম্বরে। মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা কমিটি বাতিল করে ৩ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে এ অঞ্চলে বিএনপির রাজনীতিতে প্রায় ২০ বছর ধরে আধিপত্য ধরে রাখা নগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বাদ পড়েন। আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান দেওয়া হয় সরোয়ারবিরোধী নেতাদের। একই ঘটনা ঘটে উত্তর ও দক্ষিণ জেলা কমিটিতে। মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, আহ্বায়ক কমিটি থেকে এমন অনেকে বাদ পড়েছেন, যাঁরা বিএনপির ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতা।

বাদ পড়াদের একজন মহানগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে শ্রম-ত্যাগের বিনিময়ে এবং দমনপীড়ন সহ্য করে বরিশালে দলকে শক্তিশালী করেছি। আজ আমরাই দলের কাছে উপেক্ষিত। এখন সাংগঠনিকভাবে দলে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই।’
তবে কোন্দল নেই দাবি করে নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান বলেন, আহ্বায়ক কমিটির আকার ছোট। তাই সবাইকে জায়গা দেওয়া যায়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে সবাই জায়গা পাবেন। তাঁরা এখন এক দফার আন্দোলন নিয়েই ব্যস্ত।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর ঘোষিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন মজিবর রহমান এবং সদস্যসচিব ছিলেন আকতার হোসেন। এই কমিটির বিরুদ্ধে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর নগরে বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিত নেতারা। পরে তাঁরা জেলা ও মহানগর বিএনপির কার্যালয়ে তালাও ঝুলিয়ে দেন। ওই বছরের নভেম্বরে দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন করে কমিটি দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি।

উপজেলা পর্যায়েও নেতৃত্বের লড়াই নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল দেখা দিয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলা এবং গৌরনদী পৌর কমিটি করা হয়, যা নিয়ে বিরোধ চলছে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভও করেছেন পদবঞ্চিত নেতারা। উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য এস এম আফজাল ওই সময় অভিযোগ করেছিলেন, কমিটিগুলোতে স্থান পাওয়া ব্যক্তিরা সংস্কারপন্থী, জাতীয় পার্টি থেকে আসা নেতা ও ব্যবসায়ী। মামলা-হামলার শিকার ত্যাগী নেতাদের কমিটিতে উপেক্ষা করা হয়েছে।
এ ছাড়া ১৪ ফেব্রুয়ারি মুলাদী উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেন আগের কমিটির নেতা-কর্মীরা। ওই মিছিলে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ হামলা করে বলে অভিযোগ। এ সময় উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুস ছত্তার খানের বাড়িতেও হামলা হয়। আবদুস ছত্তার প্রথম আলোকে বলেন, মুলাদী উপজেলা ও পৌর বিএনপির যে কমিটি দেওয়া হয়েছে, তাতে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। অনেকেই এলাকায় থাকেন না। এখন এখানে দল চার ভাগে বিভক্ত।

নতুন কমিটি ঘোষণার পর থেকে বাকেরগঞ্জেও বিক্ষোভ চলছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কমিটি প্রত্যাখ্যান করে সংবাদ সম্মেলন করেন আগের কমিটির নেতারা। পরে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে বর্তমান কমিটির সমর্থকেরা হামলা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দলীয় কোন্দলের বিষয়ে নগর ও জেলা বিএনপির পাঁচজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে‌ বলেন, দলের মধ্যে স্থায়ী ঐক্য নেই। সবাই নেতা, কেউ কাউকে মানছেন না। এখন এক দফার আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকবেন, নাকি কোন্দল মেটাবেন—বুঝতে পারছেন না।

আন্দোলন নিয়ে মাঠে থাকায় কমিটির ব্যাপারে নজর দেওয়ার সময় এখন হয় না বলে দাবি উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি নিয়ে ঝামেলা আছে। এগুলো আমরা ঠিক করার চেষ্টা করছি।’

দলে কোন্দল নেই দাবি করে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান বলেন, তাঁর আওতার সব কটি ইউনিটের কমিটিগুলো সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করা হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়াদের এসব পছন্দ না-ও হতে পারে। তবে কাউন্সিলের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হলে সবাই পদ পাবেন।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

বরিশালে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে কোন্দল আরও বেড়েছে

আপডেট সময় : ১১:৫৯:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৪ সেপ্টেম্বর ২০২৩

বরিশালে অভ্যন্তরীণ কোন্দলের তীব্রতা বেড়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপিতে। ক্ষমতাসীন দলে পরিবারকেন্দ্রিক আধিপত্য বিস্তার নিয়ে পুরোনো বিরোধ এখন বেড়েছে জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিএনপি যখন আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার কথা বলছে, তখন দলটিতে কোন্দল চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে বরিশাল-৫ (সদর) আসনে বিদায়ী মেয়র সাদিক আবদুল্লাহ প্রার্থী হতে পারেন—এমন গুঞ্জন থেকে আওয়ামী লীগের কোন্দল মাথাচাড়া দিয়েছে। এ আসনে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক। তাঁর সঙ্গে সাদিক আবদুল্লাহর বিরোধ অনেক পুরোনো। বিএনপিতে উপজেলা থেকে শুরু করে মহানগর পর্যন্ত কমিটি নিয়ে কোন্দলের জেরে নিজেদের মধ্যে মারামারি, বিক্ষোভ, দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝোলানোর মতো ঘটনা প্রায়ই ঘটছে।
জাহিদ ফারুক বরিশাল-৫ (সদর) আসনের বর্তমান সংসদ সদস্য। তিনি জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি। অন্যদিকে সাদিক আবদুল্লাহ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। মেয়র পদে মনোনয়ন না পাওয়ায় সাদিক আবদুল্লাহর রাজনীতি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। অবস্থান ধরে রাখতে সংসদ নির্বাচনে সদর আসনের মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে নিজেকে দাঁড় করাচ্ছেন তিনি। দলের সহযোগী সংগঠনে সমর্থকদের নেতৃত্বে আনা, দল গোছানো থেকে শুরু করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার-প্রচারণা সেই তৎপরতার অংশ বলে মনে হচ্ছে।

দলীয় সূত্র জানায়, জাহিদ ফারুকের বিরুদ্ধে প্রার্থী দেওয়ার তৎপরতা শুরু হয় গত ঈদুল আজহার পর। ঈদের দিন রাতে হঠাৎ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের নিয়ে ভূরিভোজের আয়োজন করেন সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব উদ্দিন আহমেদ বীর বিক্রম। সাদিক আবদুল্লাহসহ মহানগর আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা সেখানে যোগ দিলেও আমন্ত্রণ পাননি জাহিদ ফারুক ও নবনির্বাচিত মেয়র খায়ের আবদুল্লাহ। মাহবুব উদ্দিনকে মাঠে নামানোর পেছনে সাদিক আবদুল্লাহর সায় ছিল, নগরে এমন গুঞ্জন আছে। অবশ্য মাসখানেক আগে মনোনয়নপ্রত্যাশী হিসেবে দৃশ্যপটে আসেন সাদিক আবদুল্লাহ।

দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সিটি নির্বাচনে মনোনয়নবঞ্চিত হওয়ার পর থেকে বরিশালে অনুপস্থিত ছিলেন সাদিক আবদুল্লাহ। প্রায় আড়াই মাস পর ২২ জুন যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশকে নিয়ে বরিশালে ফেরেন তিনি। তাঁর নেতৃত্বে দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে নগরে বিশাল শোভাযাত্রা হয়। সেই আয়োজনে নবনির্বাচিত মেয়র খায়ের আবদুল্লাহ ও তাঁর সমর্থক নেতা-কর্মীদের দেখা যায়নি। এরপর ঈদুল আজহার নামাজ শেষে চাচা খায়ের আবদুল্লাহর সঙ্গে কোলাকুলি করলেও সেখানে উপস্থিত প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেননি সাদিক।

জাতীয় শোক দিবস ও ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় নিহত ব্যক্তিদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠানে খায়ের আবদুল্লাহ সদর আসনে আবার জাহিদ ফারুককে মনোনয়ন দেওয়ার আহ্বান জানান। ওই সভায় পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী প্রধান অতিথি ছিলেন। তাঁরা দুজন ঐক্যবদ্ধভাবে বরিশালের উন্নয়নে কাজ করার অঙ্গীকারও ব্যক্ত করেন।

দলীয় সূত্র জানায়, ২০১৪ সালে সাবেক মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি শওকত হোসেন হিরণের মৃত্যুর পর বরিশালের রাজনীতিতে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর ক্ষমতা নিরঙ্কুশ হয়। এ সময় শওকতের সমর্থকেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। ২০১৮ সালে সংসদ সদস্য হলে ওই নেতা-কর্মীদের অনেকে জাহিদ ফারুকের পক্ষে অবস্থান নেন। এতে দলে আলাদা বলয় তৈরি হয়। সিটি নির্বাচনে যে বলয়টি খায়ের আবদুল্লাহর পক্ষে কাজ করে। এতে আওয়ামী লীগে বিভেদ প্রকাশ্যে আসে।
ব্যাপারে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি সাড়া দেননি। তাঁর ঘনিষ্ঠ মহানগর আওয়ামী লীগের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আফজালুল করিম বলেন, ‘বর্তমান সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে মানুষের কোনো অভিযোগ নেই। তিনি সজ্জন ব্যক্তি। দলের সভাপতি অবশ্যই জনকল্যাণ হয়, এমন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেবেন। গত সিটি নির্বাচনে আমরা এর প্রমাণ পেয়েছি।’

সাদিক আবদুল্লাহর ঘনিষ্ঠ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তালুকদার মো. ইউনুস বলেন, ‘এখানে যিনি নৌকা পাবেন, তাঁর পক্ষে দল ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে।’ দলীয় বিভেদ প্রভাব ফেলবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘সিটি নির্বাচনেই তো প্রভাব পড়েনি। আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে নৌকার জয় নিশ্চিত করতে কাজ করেছি। ভবিষ্যতেও প্রভাব পড়বে না।’
বরিশালে বিএনপির সাংগঠনিক বিপর্যয় শুরু মূলত ২০২১ সালের নভেম্বরে। মহানগর, উত্তর ও দক্ষিণ জেলা কমিটি বাতিল করে ৩ নভেম্বর আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করা হয়। এতে এ অঞ্চলে বিএনপির রাজনীতিতে প্রায় ২০ বছর ধরে আধিপত্য ধরে রাখা নগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বাদ পড়েন। আহ্বায়ক কমিটিতে স্থান দেওয়া হয় সরোয়ারবিরোধী নেতাদের। একই ঘটনা ঘটে উত্তর ও দক্ষিণ জেলা কমিটিতে। মাঠ পর্যায়ের নেতাদের অভিযোগ, আহ্বায়ক কমিটি থেকে এমন অনেকে বাদ পড়েছেন, যাঁরা বিএনপির ত্যাগী-পরীক্ষিত নেতা।

বাদ পড়াদের একজন মহানগর বিএনপির সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রজীবন থেকে শ্রম-ত্যাগের বিনিময়ে এবং দমনপীড়ন সহ্য করে বরিশালে দলকে শক্তিশালী করেছি। আজ আমরাই দলের কাছে উপেক্ষিত। এখন সাংগঠনিকভাবে দলে কোনো চেইন অব কমান্ড নেই।’
তবে কোন্দল নেই দাবি করে নগর বিএনপির আহ্বায়ক মনিরুজ্জামান খান বলেন, আহ্বায়ক কমিটির আকার ছোট। তাই সবাইকে জায়গা দেওয়া যায়নি। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হলে সবাই জায়গা পাবেন। তাঁরা এখন এক দফার আন্দোলন নিয়েই ব্যস্ত।
২০২১ সালের ৩ নভেম্বর ঘোষিত দক্ষিণ জেলা বিএনপির কমিটিতে আহ্বায়ক ছিলেন মজিবর রহমান এবং সদস্যসচিব ছিলেন আকতার হোসেন। এই কমিটির বিরুদ্ধে গত বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর নগরে বিক্ষোভ করেন পদবঞ্চিত নেতারা। পরে তাঁরা জেলা ও মহানগর বিএনপির কার্যালয়ে তালাও ঝুলিয়ে দেন। ওই বছরের নভেম্বরে দক্ষিণ জেলার আহ্বায়ক কমিটি বিলুপ্ত করে নতুন করে কমিটি দেয় কেন্দ্রীয় বিএনপি।

উপজেলা পর্যায়েও নেতৃত্বের লড়াই নিয়ে বিএনপিতে কোন্দল দেখা দিয়েছে। গত ৮ জানুয়ারি আগৈলঝাড়া ও গৌরনদী উপজেলা এবং গৌরনদী পৌর কমিটি করা হয়, যা নিয়ে বিরোধ চলছে। গত ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভও করেছেন পদবঞ্চিত নেতারা। উত্তর জেলা বিএনপির সদস্য এস এম আফজাল ওই সময় অভিযোগ করেছিলেন, কমিটিগুলোতে স্থান পাওয়া ব্যক্তিরা সংস্কারপন্থী, জাতীয় পার্টি থেকে আসা নেতা ও ব্যবসায়ী। মামলা-হামলার শিকার ত্যাগী নেতাদের কমিটিতে উপেক্ষা করা হয়েছে।
এ ছাড়া ১৪ ফেব্রুয়ারি মুলাদী উপজেলা ও পৌর বিএনপির আহ্বায়ক কমিটি বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ করেন আগের কমিটির নেতা-কর্মীরা। ওই মিছিলে যুবলীগ ও ছাত্রলীগ হামলা করে বলে অভিযোগ। এ সময় উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আবদুস ছত্তার খানের বাড়িতেও হামলা হয়। আবদুস ছত্তার প্রথম আলোকে বলেন, মুলাদী উপজেলা ও পৌর বিএনপির যে কমিটি দেওয়া হয়েছে, তাতে সরকারি দলের পৃষ্ঠপোষকতা আছে। অনেকেই এলাকায় থাকেন না। এখন এখানে দল চার ভাগে বিভক্ত।

নতুন কমিটি ঘোষণার পর থেকে বাকেরগঞ্জেও বিক্ষোভ চলছে। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি কমিটি প্রত্যাখ্যান করে সংবাদ সম্মেলন করেন আগের কমিটির নেতারা। পরে তাঁরা বিক্ষোভ মিছিল বের করলে বর্তমান কমিটির সমর্থকেরা হামলা করেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

দলীয় কোন্দলের বিষয়ে নগর ও জেলা বিএনপির পাঁচজন নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে‌ বলেন, দলের মধ্যে স্থায়ী ঐক্য নেই। সবাই নেতা, কেউ কাউকে মানছেন না। এখন এক দফার আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথে থাকবেন, নাকি কোন্দল মেটাবেন—বুঝতে পারছেন না।

আন্দোলন নিয়ে মাঠে থাকায় কমিটির ব্যাপারে নজর দেওয়ার সময় এখন হয় না বলে দাবি উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক দেওয়ান মোহাম্মাদ শহীদুল্লাহর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কমিটি নিয়ে ঝামেলা আছে। এগুলো আমরা ঠিক করার চেষ্টা করছি।’

দলে কোন্দল নেই দাবি করে দক্ষিণ জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল হোসেন খান বলেন, তাঁর আওতার সব কটি ইউনিটের কমিটিগুলো সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে করা হয়েছে। কাঙ্ক্ষিত পদ না পাওয়াদের এসব পছন্দ না-ও হতে পারে। তবে কাউন্সিলের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ কমিটি করা হলে সবাই পদ পাবেন।