ঢাকা ০২:০৪ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি ::
আমাদের নিউজপোর্টালে আপনাকে স্বাগতম... সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে...

‘কিশোর গ্যাং’ প্রশ্রয় দেন ঢাকার ২১ কাউন্সিলর

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ১১:৩৬:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪ ৪৮ বার পড়া হয়েছে

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় বছর সাতেক আগে ১১ জন ব্যক্তি মিলে ৪ শতাংশ জমি কেনেন। তিন মাস আগে সেই জমিতে ভবন নির্মাণ করতে গেলে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন স্থানীয় ‘গাংচিল বাহিনী’র সদস্যরা। জমির মালিকেরা পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে পেরেছেন।

মালিকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাঁদার টাকা দিতে একটু দেরি হয়েছিল। সে কারণে নির্মাণশ্রমিকদের মারধর করা হয়েছিল। গাংচিল বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে ওই এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করা যায় না।

এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাংচিল বাহিনীর নেতা মো. মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে প্রশ্রয় দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ।

আসিফ আহমেদ গত ২১ জানুয়ারি বলেন, ‘আমার সঙ্গে কোনো অপরাধীর সখ্য নেই। আমি চার বছর হলো রাজনীতিতে এসেছি। এসব অপরাধী আগে থেকেই এলাকায় ছিল।’

অবশ্য এলাকাবাসী বলছেন, আসিফ কাপ্রথমউন্সিলর হয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং তাদের প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করেন। গাংচিল বাহিনীর সদস্যরা আসিফের সভা ও মিছিলে অংশ নেন। মোশারফের পাশে বসা অবস্থায় আসিফের ছবিও রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোশাররফ যুবলীগের পদ পাওয়ার চেষ্টায় আছেন।
অনুসন্ধান ও পুলিশের নিজস্ব প্রতিবেদন সূত্রে ঢাকায় গাংচিল বাহিনীর মতো অন্তত ৮০টি বাহিনীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর বেশির ভাগ ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত। নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তাঁরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, কেব্‌ল টিভি (ডিশ) ব্যবসা ও ময়লা–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত।

বাহিনীগুলোর নেতাদের কেউ কেউ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করেন। কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও আশ্রয় পান রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। পুলিশের একটি প্রতিবেদনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘গ্যাং’ প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এসেছে।

সারা দেশের ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে পুলিশ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল ২০২২ সালের শেষ দিকে। এতে বলা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন।
ঢাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তার চেয়ে এখন পরিস্থিতি খারাপ। যেমন পুলিশের তালিকার বাইরে ঢাকায় আরও অন্তত ১৪টি কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে।

বাহিনীগুলো শুধু অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টির কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট।

কিশোর গ্যাং নতুন করে আলোচনায় এসেছে ৯ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে একটি খুনের ঘটনায়। ওই দিন ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করার জেরে নীরব হোসেন (১৭) নামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে খুন করেন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চর থেকে মিলন হোসেন (২৭) নামের যুবকের ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হন জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এস কে সজীব। পুলিশ বলছে, তিনি একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। এখন ক্ষমতাসীন দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো কোনো নেতার নাম আসছে। অপরাধী বাহিনীর রাজনৈতিক সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ৯ ফেব্রুয়ারি বলেন, ‘যারা কিশোর গ্যাংয়ের নামে অপরাধ কার্যক্রম চালায়, তাদেরকে আমরা সন্ত্রাসী বলব। সন্ত্রাসীদের কোনো নির্দিষ্ট দল নেই।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীরা যে–ই হোক না কেন, আমরা তাদের শক্ত হাতে দমন করছি, ভবিষ্যতেও করব।’

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাহিনীগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এসব বাহিনী এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। রাজধানীতে, বড় শহরে মানুষের নিরাপদ বসবাসের ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে এসব বাহিনী।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

‘কিশোর গ্যাং’ প্রশ্রয় দেন ঢাকার ২১ কাউন্সিলর

আপডেট সময় : ১১:৩৬:২৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী ২০২৪

রাজধানীর মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান এলাকায় বছর সাতেক আগে ১১ জন ব্যক্তি মিলে ৪ শতাংশ জমি কেনেন। তিন মাস আগে সেই জমিতে ভবন নির্মাণ করতে গেলে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেন স্থানীয় ‘গাংচিল বাহিনী’র সদস্যরা। জমির মালিকেরা পাঁচ লাখ টাকা চাঁদা দিয়ে ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে পেরেছেন।

মালিকদের একজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চাঁদার টাকা দিতে একটু দেরি হয়েছিল। সে কারণে নির্মাণশ্রমিকদের মারধর করা হয়েছিল। গাংচিল বাহিনীকে চাঁদা না দিয়ে ওই এলাকায় কোনো ভবন নির্মাণ করা যায় না।

এলাকাবাসী ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গাংচিল বাহিনীর নেতা মো. মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ পুলিশের তালিকাভুক্ত অপরাধী। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ১৫টি মামলা রয়েছে। তাঁকে ও তাঁর বাহিনীকে প্রশ্রয় দেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর আসিফ আহমেদ।

আসিফ আহমেদ গত ২১ জানুয়ারি বলেন, ‘আমার সঙ্গে কোনো অপরাধীর সখ্য নেই। আমি চার বছর হলো রাজনীতিতে এসেছি। এসব অপরাধী আগে থেকেই এলাকায় ছিল।’

অবশ্য এলাকাবাসী বলছেন, আসিফ কাপ্রথমউন্সিলর হয়ে অপরাধীদের বিরুদ্ধে অবস্থান না নিয়ে বরং তাদের প্রশ্রয় দেওয়া শুরু করেন। গাংচিল বাহিনীর সদস্যরা আসিফের সভা ও মিছিলে অংশ নেন। মোশারফের পাশে বসা অবস্থায় আসিফের ছবিও রয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোশাররফ যুবলীগের পদ পাওয়ার চেষ্টায় আছেন।
অনুসন্ধান ও পুলিশের নিজস্ব প্রতিবেদন সূত্রে ঢাকায় গাংচিল বাহিনীর মতো অন্তত ৮০টি বাহিনীর খোঁজ পাওয়া গেছে, যেগুলোর বেশির ভাগ ‘কিশোর গ্যাং’ নামে পরিচিত। নামে কিশোর গ্যাং হলেও এসব বাহিনীর বেশির ভাগ সদস্যের বয়স ১৮ বছরের বেশি। তাঁরা ছিনতাই, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, জমি দখলে সহায়তা, ইন্টারনেট সংযোগ, কেব্‌ল টিভি (ডিশ) ব্যবসা ও ময়লা–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, উত্ত্যক্ত করা, যৌন হয়রানি করা, হামলা, মারধরসহ নানা অপরাধে জড়িত।

বাহিনীগুলোর নেতাদের কেউ কেউ সরাসরি ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতি করেন। কেউ কেউ রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও আশ্রয় পান রাজনীতিবিদদের কাছ থেকে। পুলিশের একটি প্রতিবেদনে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অন্তত ২১ জন কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে ‘গ্যাং’ প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ এসেছে।

সারা দেশের ‘কিশোর গ্যাং’ নিয়ে পুলিশ প্রতিবেদন তৈরি করেছিল ২০২২ সালের শেষ দিকে। এতে বলা হয়েছে, সারা দেশে অন্তত ১৭৩টি কিশোর গ্যাং রয়েছে। বিভিন্ন অপরাধে এদের বিরুদ্ধে মামলা রয়েছে ৭৮০টি। এসব মামলায় আসামি প্রায় ৯০০ জন। রাজধানীতে কিশোর গ্যাং রয়েছে ৬৬টি। চট্টগ্রাম শহরে আছে ৫৭টি। মহানগরের বাইরে ঢাকা বিভাগে রয়েছে ২৪টি গ্যাং। বেশির ভাগ বাহিনীর সদস্য ১০ থেকে ৫০ জন।
ঢাকায় অনুসন্ধান চালিয়ে ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পুলিশের প্রতিবেদনে যে চিত্র উঠে এসেছিল, তার চেয়ে এখন পরিস্থিতি খারাপ। যেমন পুলিশের তালিকার বাইরে ঢাকায় আরও অন্তত ১৪টি কিশোর গ্যাংয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে।

বাহিনীগুলো শুধু অপরাধই করে না, আধিপত্য বজায় রাখতে পরস্পরের সঙ্গে সংঘর্ষেও জড়ায়। ডিএমপি সূত্র বলছে, ২০২৩ সালে রাজধানীতে যত খুন হয়েছে তার ২৫টির কিশোর গ্যাং সংশ্লিষ্ট।

কিশোর গ্যাং নতুন করে আলোচনায় এসেছে ৯ ফেব্রুয়ারি মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে একটি খুনের ঘটনায়। ওই দিন ছাত্রীদের উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করার জেরে নীরব হোসেন (১৭) নামের এক এসএসসি পরীক্ষার্থীকে ছুরিকাঘাত করে খুন করেন কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা।
এর আগে ৩ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ায় পদ্মা নদীর চর থেকে মিলন হোসেন (২৭) নামের যুবকের ৯ টুকরা লাশ উদ্ধার করা হয়। হত্যার ঘটনায় জড়িত সন্দেহে গ্রেপ্তার হন জেলা ছাত্রলীগের বহিষ্কৃত সহসভাপতি এস কে সজীব। পুলিশ বলছে, তিনি একটি কিশোর গ্যাংয়ের নেতা।

ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসীরা বিভিন্ন বাহিনীর নেতৃত্ব দিতেন। এখন ক্ষমতাসীন দল এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কোনো কোনো নেতার নাম আসছে। অপরাধী বাহিনীর রাজনৈতিক সংযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান ৯ ফেব্রুয়ারি বলেন, ‘যারা কিশোর গ্যাংয়ের নামে অপরাধ কার্যক্রম চালায়, তাদেরকে আমরা সন্ত্রাসী বলব। সন্ত্রাসীদের কোনো নির্দিষ্ট দল নেই।’ তিনি বলেন, ‘অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িত সন্ত্রাসীরা যে–ই হোক না কেন, আমরা তাদের শক্ত হাতে দমন করছি, ভবিষ্যতেও করব।’

অবশ্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বাহিনীগুলো একদিনে গড়ে ওঠেনি। রাজনীতিবিদদের প্রশ্রয় ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তায় এসব বাহিনী এখন ভয়ংকর রূপ নিয়েছে। রাজধানীতে, বড় শহরে মানুষের নিরাপদ বসবাসের ক্ষেত্রে বড় হুমকি হয়ে উঠেছে এসব বাহিনী।