ঢাকা ০৬:৩৬ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ০১ মে ২০২৪, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
বিজ্ঞপ্তি ::
আমাদের নিউজপোর্টালে আপনাকে স্বাগতম... সারাদেশে প্রতিনিধি নিয়োগ চলছে...

কৃষক-ভোক্তা নাকি সিন্ডিকেট, কার স্বার্থ বেশি

প্রতিনিধির নাম
  • আপডেট সময় : ০৯:৩১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ নভেম্বর ২০২৩ ১৫৬ বার পড়া হয়েছে

আলুর বাজার লাগামহীন হতে হতে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকার খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আলু ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আলুর বাজারের এই নিয়ন্ত্রণহীনতা দুই মাস ধরেই চলে আসছিল।

দাম নিয়ন্ত্রণে ডিম, পেঁয়াজের সঙ্গে আলুর দামও বেঁধে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজার তদারকিতে কয়েক দিন ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে কিছু অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। দেশে আলুর চাহিদার চেয়ে উৎপাদন উদ্বৃত্ত বলে কৃষি মন্ত্রণালয় যখন আলু রপ্তানি করছে, সে সময় কৃষিপণ্যটির দাম কেন দেশের বাজারে রেকর্ড ছোঁবে আর কেনই–বা আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে?

কৃষিমন্ত্রী আলুর এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোল্ডস্টোরেজের মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। ভোক্তা অধিকারও মজুত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছে। কিন্তু প্রথম আলোর খবর বলছে, বাংলাদেশের আলুর সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী জেলা মুন্সিগঞ্জে এক মাসের বেশি সময় ধরে বাজার তদারকিতে প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। এই প্রেক্ষাপটে দুই মাস ধরে উচ্চ দামে স্থিতিশীল থাকা আলুর বাজার সিন্ডিকেটের আরও বেশি মুনাফার জন্য যে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সেটা বললে অত্যুক্তি হবে না।
তদারকিতে ব্যর্থ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজারে আলুর সরবরাহ বাড়িয়ে দাম স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রেও ব্যর্থ হয়েছে। দুই মাস ধরে আলুর বাজার অস্থিতিশীল থাকলেও আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে। প্রশ্ন হলো, এক মাস পরই যখন বাজার নতুন আলু উঠতে শুরু করবে, তখন আমদানির এই সিদ্ধান্ত আসলে কতটা লোকদেখানো পদক্ষেপ আর কতটা বাস্তবসম্মত? এর আগে ডিমের ক্ষেত্রেও আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। দেড় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও একটি ডিমও আমদানি হয়ে আসেনি। এ কারণে আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও সেই আলু দেশের বাজারে কবে পৌঁছাবে কিংবা আদৌ পৌঁছাবে কি না, সেই নিশ্চয়তা নেই।

শতভাগ দেশে উৎপাদিত আলুর মতো কৃষিপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও কম নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়, কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির একটি ধারাবাহিক পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা। কিন্তু সংকট তৈরি হলেই এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলুর ক্ষেত্রেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে চলতি অর্থবছরে যে আলু উৎপাদিত হয়েছে, সেটা চাহিদার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন বেশি। কাগজে-কলমে যদি এত উদ্বৃত্তই থাকবে, তাহলে যে আলু উৎপাদনের পর কৃষক ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করলেন, সেই আলু কীভাবে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হবে? বাজার স্থিতিশীল রাখতে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও চাহিদার বাস্তবসম্মত পরিসংখ্যান তৈরি করা যে অত্যাবশ্যকীয়, সেই উপলব্ধি আমাদের কবে হবে?
আলুর দাম নিয়ে ফি বছরই কারসাজি চলছে। এই কারসাজি হয় মূলত হিমাগার পর্যায়ে। আলুর দাম বাড়লেও কৃষকের কোনো লাভ নেই। কেননা তাঁদের কাছে আলু থাকে মূলত জুন মাস পর্যন্ত। সে সময়ে তাঁরা কম মূল্যে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন। জুলাই মাস থেকেই বাজার চড়তে থাকে। এ সময় আলুর বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হিমাগারকেন্দ্রিক ফড়িয়া, হিমাগারের মালিক ও আড়তদারদের হাতে। তাঁরা সিন্ডিকেট করে দফায় দফায় আলুর দাম বাড়ান। ইচ্ছেমতো ভোক্তাদের পকেট থেকে টাকা তুলে নেন।

বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা, বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা—আলুর বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হওয়ার পেছনে কারও দায়কেই আলাদা করার সুযোগ নেই। সবাই জানে, আলুর বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে সিন্ডিকেট দায়ী। কিন্তু শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সেই সিন্ডিকেট ভাঙবে কে? কিন্তু সবার আগে কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ দেখবে, নাকি সিন্ডিকেটের স্বার্থ দেখবে—সরকারকে সেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

নিউজটি শেয়ার করুন

আপলোডকারীর তথ্য

কৃষক-ভোক্তা নাকি সিন্ডিকেট, কার স্বার্থ বেশি

আপডেট সময় : ০৯:৩১:৪৯ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ নভেম্বর ২০২৩

আলুর বাজার লাগামহীন হতে হতে সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ঢাকার খুচরা বাজারে কেজিপ্রতি আলু ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে আলু আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আলুর বাজারের এই নিয়ন্ত্রণহীনতা দুই মাস ধরেই চলে আসছিল।

দাম নিয়ন্ত্রণে ডিম, পেঁয়াজের সঙ্গে আলুর দামও বেঁধে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাজার তদারকিতে কয়েক দিন ভোক্তা অধিকারের পক্ষ থেকে কিছু অভিযানও চালানো হয়। কিন্তু তাতে কোনো লাভ হয়নি। দেশে আলুর চাহিদার চেয়ে উৎপাদন উদ্বৃত্ত বলে কৃষি মন্ত্রণালয় যখন আলু রপ্তানি করছে, সে সময় কৃষিপণ্যটির দাম কেন দেশের বাজারে রেকর্ড ছোঁবে আর কেনই–বা আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে হবে?

কৃষিমন্ত্রী আলুর এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য কোল্ডস্টোরেজের মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। ভোক্তা অধিকারও মজুত ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছে। কিন্তু প্রথম আলোর খবর বলছে, বাংলাদেশের আলুর সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী জেলা মুন্সিগঞ্জে এক মাসের বেশি সময় ধরে বাজার তদারকিতে প্রশাসনের কোনো নজরদারি নেই। এই প্রেক্ষাপটে দুই মাস ধরে উচ্চ দামে স্থিতিশীল থাকা আলুর বাজার সিন্ডিকেটের আরও বেশি মুনাফার জন্য যে সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়েছে, সেটা বললে অত্যুক্তি হবে না।
তদারকিতে ব্যর্থ বাণিজ্য মন্ত্রণালয় বাজারে আলুর সরবরাহ বাড়িয়ে দাম স্থিতিশীল করার ক্ষেত্রেও ব্যর্থ হয়েছে। দুই মাস ধরে আলুর বাজার অস্থিতিশীল থাকলেও আমদানির সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেছে। প্রশ্ন হলো, এক মাস পরই যখন বাজার নতুন আলু উঠতে শুরু করবে, তখন আমদানির এই সিদ্ধান্ত আসলে কতটা লোকদেখানো পদক্ষেপ আর কতটা বাস্তবসম্মত? এর আগে ডিমের ক্ষেত্রেও আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। দেড় মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও একটি ডিমও আমদানি হয়ে আসেনি। এ কারণে আমদানির সিদ্ধান্ত নিলেও সেই আলু দেশের বাজারে কবে পৌঁছাবে কিংবা আদৌ পৌঁছাবে কি না, সেই নিশ্চয়তা নেই।

শতভাগ দেশে উৎপাদিত আলুর মতো কৃষিপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে কৃষি মন্ত্রণালয়ের ভূমিকাও কম নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা যায়, কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধির একটি ধারাবাহিক পরিসংখ্যান উপস্থাপন করা। কিন্তু সংকট তৈরি হলেই এই পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তবতার ফারাকটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। আলুর ক্ষেত্রেই কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, দেশে চলতি অর্থবছরে যে আলু উৎপাদিত হয়েছে, সেটা চাহিদার চেয়ে ১৫ থেকে ২০ লাখ টন বেশি। কাগজে-কলমে যদি এত উদ্বৃত্তই থাকবে, তাহলে যে আলু উৎপাদনের পর কৃষক ১০ থেকে ১২ টাকায় বিক্রি করলেন, সেই আলু কীভাবে ৬৫ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হবে? বাজার স্থিতিশীল রাখতে কৃষিপণ্য উৎপাদন ও চাহিদার বাস্তবসম্মত পরিসংখ্যান তৈরি করা যে অত্যাবশ্যকীয়, সেই উপলব্ধি আমাদের কবে হবে?
আলুর দাম নিয়ে ফি বছরই কারসাজি চলছে। এই কারসাজি হয় মূলত হিমাগার পর্যায়ে। আলুর দাম বাড়লেও কৃষকের কোনো লাভ নেই। কেননা তাঁদের কাছে আলু থাকে মূলত জুন মাস পর্যন্ত। সে সময়ে তাঁরা কম মূল্যে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হন। জুলাই মাস থেকেই বাজার চড়তে থাকে। এ সময় আলুর বাজারের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় হিমাগারকেন্দ্রিক ফড়িয়া, হিমাগারের মালিক ও আড়তদারদের হাতে। তাঁরা সিন্ডিকেট করে দফায় দফায় আলুর দাম বাড়ান। ইচ্ছেমতো ভোক্তাদের পকেট থেকে টাকা তুলে নেন।

বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা, বাণিজ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার সমন্বয়হীনতা, বাজার তদারকি সংস্থাগুলোর সমন্বয়হীনতা—আলুর বাজার সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হওয়ার পেছনে কারও দায়কেই আলাদা করার সুযোগ নেই। সবাই জানে, আলুর বাজার অস্থিতিশীল করার পেছনে সিন্ডিকেট দায়ী। কিন্তু শর্ষের মধ্যে ভূত থাকলে সেই সিন্ডিকেট ভাঙবে কে? কিন্তু সবার আগে কৃষক ও ভোক্তার স্বার্থ দেখবে, নাকি সিন্ডিকেটের স্বার্থ দেখবে—সরকারকে সেই নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে হবে।